কাউন্সিলর রুনু খান ও তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড
কখনও রাজনীতি, কখনও কালো টাকা, আবার কখনও মাদক কিংবা সন্ত্রাসের আশ্রয়ে এদেশে জন্ম হয়েছে এরশাদ শিকদার থেকে শুরু করে নয়ন বন্ড এর মত অনেক ছোট বড় সন্ত্রাসীর। এদের অধিকাংশকেই শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি। তবে কেউ কেউ আবার পারও পেয়ে যায়। তাই আজও বাংলাদেশ সন্ত্রাসমুক্ত কিংবা মাদকমুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আর সন্ত্রাসীদের ত্রাসের রাজত্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য বিলাসিতা!
বাংলাদেশের ঠিক মাঝ বরাবর উত্তরের জেলা জামালপুর। জামালপুর সদর সম্প্রীতির শহর হিসেবে সকলের কাছেই পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শান্তির এ শহরে অশান্তি বিরাজ করছে। আর এ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত জামালপুর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসানুজ্জামান খান রুনু ও তার পুত্র জেলা ছাত্রলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক রাকিব খান। পিতা ও পুত্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ শহরবাসী দীর্ঘদিন যাবত এদের সহ্য করে আসলেও এখন তা অসহনীয় পর্যায় চলে গেছে। একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এরা শহরে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। যারাই এদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে সবাইকেই হতে হয়েছে মারধরের শিকার।
ভূমিদস্যু রুনু খান ও ছেলে ছাত্রলীগ নেতা রাকিব খান |
তবে এদের কর্মকাণ্ড সারা দেশের মানুষের সামনে চলে আসে যখন এরা জামালপুর জেলার একজন সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা মনজুর ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়।
ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি জাল দলিলকে কেন্দ্র করে। শহরের দেওয়ানপাড়া এলাকার রফিকুল ইসলামের মালিকানাধীন ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি দলিল লেখক হাবিবুর রহমান জাল দলিল করতে জাল খারিজ, জাল খতিয়ানসহ অন্যান্য কাগজপত্র সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দিলে সাব-রেজিস্ট্রার সাখাওয়াত হোসেন সেগুলো জব্দ করেন। এ বিষয়ে জাল দলিলকারী অভিযুক্ত দলিল লেখক হাবিবুর রহমানের বক্তব্য নিতে গেলে তার ভাই পৌর কাউন্সিলর ও স্ট্যাম্প ভেন্ডার হাসানুজ্জামান খান রুনুর নেতৃত্বে তার ছেলে রাকিব খান, ভাতিজা তুষার খান, তুহিন খান, স্বজন খান সহ ১০-১২ জন সন্ত্রাসী তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলাকারীরা মোস্তফা মনজুকে মারাত্মকভাবে আহত করে। যারা তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যান, তারাও মারধরের শিকার হন।
ঘটনাটি ঘটে ২৮ মে, ২০১৯ মঙ্গলবার বেলা ২ টার দিকে। উল্ল্যেক্ষ যে, সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের বড় একটি চক্র নিয়ন্ত্রন করে এই কাউন্সিলর। স্ট্যাম্প ভেন্ডার হবার সুবাদে সে ভুয়া জমা-খারিজ ও পর্চা তৈরির মাধ্যমে বানোয়াট দলিল সম্পাদন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। হাসানুজ্জামান খান রুনুর একটি সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। যার মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে তা দখল করে আসছিল এই ভূমিদস্যু।
ঘটনার দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতেই কাউন্সিলর ও স্ট্যাম্প ভেন্ডার রুনু খান, ছেলে রাকিব খান, ভাতিজা তুষার খান, তুহিন খান, স্বজন খান, দলিল লেখক হাবিবুর রহমান, মো. উকিল মিয়া, সিদ্দিক মন্ডল, আলমগীর বাচ্চু ও অজ্ঞাত পরিচয়ের একজনকে আসামি করে সাংবাদিক মোস্তফা মনজু জামালপুর সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু, কে হবে স্বাক্ষী! তাদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দেওয়াটাও যেন একটি ভীতিকর ব্যাপার!
সেই সময় মামলার প্রধান স্বাক্ষী হন আরেক সাংবাদিক শেলু আকন্দ। আর এর পর থেকেই ভূমিদস্যু রুনু খান ও তার ছেলে রাকিব খান তাকে মামলায় স্বাক্ষী না দেওয়ার জন্য নানা রকম হুমকি-ধামকি দিতে থাকে। এর মধ্যে ভূমিদস্যু রুনু খান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী সাংবাদিক মোস্তফা মনজুর ওপর হামলাকারীদের বিচার চেয়ে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করা অন্যান্য সাংবাদিকদেরও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিল। যার ফলশ্রুতিতে শহরের ৪৮ জন সাংবাদিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জামালপুর সদর থানায় জিডি করেন!
ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে বিষয়টি অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাবার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি!
আর এর ফলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে আসামী হাসানুজ্জামান খান রুনু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। এরই মধ্যে আরো বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটায় রাকিব খান ও তার সহযোগী সন্ত্রাসী দল। কিন্তু ভয়ে ভুক্তভোগীরা কেউই প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। আর এ কারণেই যেন ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়ে ওঠে এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী।
গত ১৮ ডিসেম্বর রাত ১১ টায় ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীনেতা রুনু খান ও তার ছেলে ছাত্রলীগনেতা রাকিব খানের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী শহরের দেওয়ানপাড়া এলাকায় শহররক্ষা বাঁধের বাইপাস সড়কে মোস্তফা মনজু মামলার প্রধান স্বাক্ষী সাংবাদিক শেলু আকন্দকে একা পেয়ে দেশীয় অস্ত্র ও লোহার পাইপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে। আক্রমণকারী দলে মোস্তফা মনজু মামলার আসামী তুষার খান, তুহিন খান ও স্বজন খানরাও উপস্থিত ছিল। তারা শেলু আকন্দকে মারাত্মকভাবে আহত করে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশের সহায়তায় মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে তার আত্মীয়-স্বজনরা। সন্ত্রাসীদের আঘাতে তার পা দুটি ভেঙ্গে যায় এবং সারা শরীর জখমে ভরে যায়। অবস্থা বেগতিক হলে তাকে দ্রুত ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়। পঙ্গুত্তের ঝুঁকি নিয়ে তিনি এখন সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনাটি জানাজানি হলে পুরো শহরবাসী উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রুনু খানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী একসাথে সরব হয়ে ওঠে। তাদের এখন একটাই দাবি, “রুনু খানের উপযুক্ত বিচার চাই”।
|
|
এ ঘটনায় ১৯ ডিসেম্বর শেলু আকন্দের বড় ভাই দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে হাসানুজ্জামান খান রুনু, ছেলে রাকিব খানসহ ৬ জনকে আসামি করে জামালপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সন্ত্রাসী রুনু খানের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা রাকিব খানকে পুলিশ ঘটনার দিনই আটক করে। কিন্তু রুনু খান সহ বাকি আসামীরা এখনও রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এক সময়ের কসাই থেকে ভূমিদস্যু হয়ে ওঠা পৌর কাউন্সিলর হাসানুজ্জামান খান রুনু শুধু একজন দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীই নয়, সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকও বটে। তার ছেলে জেলা ছত্রলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হলেও ধর্মের নামে একের পর এক অধর্মের কাজ করে যাচ্ছে। আজ রাকিব খানের যথাযত বিচার না করা গেলে একজন নয়ন বন্ড হয়ে উঠতে তার বেশি সময় লাগবে না। তাই এই সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে আজ সবাই রুখে না দাঁড়ালে একসময় এরা ফুলে ফেপে উঠবে এবং জামালপুরের মত একটি শান্তিপূর্ণ জেলাকে রুপান্তরিত করবে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে!
|
|
রুনু খান ও তার পুত্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচার চেয়ে জামালপুরবাসী আজ আন্দোলনরত। তাদের আন্দোলনে মূলত ৬ টি দাবি উঠে এসেছেঃ
১. হাসানুজ্জামান খান রুনুসহ মামলার সকল আসামিকে গ্রেফতার করতে হবে।
২. পৌরসভার কাউন্সিলরের পদ থেকে হাসানুজ্জামান খান রুনুকে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।
৩. হাসানুজ্জামান খান রুনুর স্ট্যাম্প ভেন্ডার সনদ বাতিল করতে হবে।
৪. ভুয়া জমা-খারিজ মূলে দলিল করার জন্য হাসানুজ্জামান খান রুনুর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. হাসানুজ্জামান খান রুনুর অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তদন্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. সকল সাংবাদিকের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
এছাড়াও আন্দোলনকারীরা কাউন্সিলর রুনু খান ও তার পুত্র ছাত্রলীগ নেতা রাকিব খানকে আওয়ামীলীগের সদস্যপদ থেকে আজীবন বহিষ্কারের দাবিও জানিয়েছেন। এদেরকে বহিষ্কার করা না হলে দলে সন্ত্রাসী লালনের দায়ভার কিন্তু জেলা আওয়ামীলীগ নেতাদের ওপরও বর্তাবে। এখন তারা জামালপুর আওয়ামীলীগকে কলঙ্কমুক্ত করবে, নাকি সন্ত্রাসীদের হাতেই রাজনীতি তুলে দিবে সেটাই দেখার বিষয়!
No comments:
Post a Comment