The Bizarre Quota System In Bangladesh
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যে দেশের মানুষ যুগে যুগে অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হয়েছে এবং পেয়েছে সফলতাও। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালগুলো বাঙালি জাতির ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ এবং বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতিকে পরিচিত করেছে একটি স্বাধীনচেতা, সংগ্রামী ও ত্যাগী জনগোষ্ঠী হিসেবে। কিন্তু আজ বাঙালি জাতিকে অনেকটা সুপরিকল্পিত অথবা অপরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু আমরা আমাদের এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে যথেষ্ট অযত্ন ও অবহেলা করে এক মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি। যদি এভাবে চলতে থাকে, তবে আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর এর ফলগুলো আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাব। শুধু এতেই আমরা শান্ত হইনি, আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়নও করতে শুরু করে দিয়েছি। একদিকে প্রাইভেট সেক্টরে মামা-চাচার প্রভাব, আর অন্যদিকে ভয়ঙ্কর এক কোটা ব্যবস্থা। যার ফলে দেশে তৈরি হচ্ছে হতাশাগ্রস্ত, বঞ্চিত এবং ক্ষুব্ধ এক তরুণ সমাজ। আজ তারা রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা
আমাদের দেশের সংবিধানে অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষদের উপরে তুলে আনার জন্য অস্থায়ীভাবে কোটা পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী কারা? তারা আসলে কত শতাংশ কোটা পাওয়ার যোগ্য? এবং কতদিন ধরে তারা এই সুবিধা ভোগ করে যাবে?
বর্তমানে, দেশে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনী, নারী, জেলা, উপজাতি, প্রতিবন্ধী, আনসার ও ভিডিপি, পোষ্য, খেলোয়াড়, এলাকা ও বোনসহ ২৫৭ ধরনের কোটা রয়েছে। এসব কোটা বিসিএস, সরকারি চাকরি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও ভর্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ শতাংশ কোটা। এখানে প্রতিবন্ধী কোটাটি বাধ্যতামূলক নয়।
প্রথমেই আসি উপজাতি কোটাতে। বাংলাদেশে উপজাতিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১.০৩ শতাংশ। কিছু সংস্থার মতে তা ২ শতাংশের কাছাকাছি। এরা সত্যিকার অর্থেই পিছিয়ে পড়া জাতি। যেহেতু আমরা এদেরকে পিছিয়ে পড়া জাতি বলছি, তার অর্থ এরা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। সত্যিকার অর্থেই কি তাই?
ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সালে আমাদের দেশে শিক্ষার হার ছিল ৭২.৭৬ শতাংশের মত। আমরা যদি চাকমাদের প্রসঙ্গ আনি, তাহলে দেখব, এদের শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে এরও আগে। যেখানে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩ ভাগের চেয়ে কিছু বেশি ছিল! উপজাতিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়াতে কোটার সুবিধাটাও সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে এই চাকমারাই। যার ফলে বঞ্চিত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র উপজাতি গোষ্ঠীরা।
তাহলে কি উপজাতি কোটা অযৌক্তিক? উত্তর হচ্ছে, না। কিন্তু এর সংস্কার করা দরকার। চাকমারা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষার দিক থেকে অন্যান্য উপজাতিদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। তাদেরকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আর কোনো কোটার প্রয়োজন আছে কিনা তা অবশ্যই যাচাই করে দেখা দরকার। আর আমাদের উচিৎ সুবিধাবঞ্চিত অন্যান্য ক্ষুদ্র উপজাতি গোষ্ঠীদের প্রতি আরো মনোযোগী হওয়া। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত বাঙালি পরিবারদের ব্যাপারটাও নজরে আনা দরকার।
এখন আসি সংখ্যার ব্যাপারে। আমাদের দেশে উপজাতিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১.০৩ থেকে ২ শতাংশের মত। সুতরাং, স্কুল-কলেজগুলোতে এবং কর্মক্ষেত্রেও অন্তত ১.০৩ থেকে ২ শতাংশের মত উপজাতিদের উপস্থিতি থাকার কথা। যদি তা থাকে তাহলে আমারা বলতে পারব, তারা অন্তত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অন্যদের থেকে আর পিছিয়ে নেই। ধরে নিচ্ছি, কোটা সুবিধা ছাড়া তাদের পক্ষে এই সংখ্যাটি অর্জন করা সম্ভব না। ধরে নিলাম, কোটা সুবিধা ছাড়া মাত্র ০.৫ শতাংশ জায়গা উপজাতিদের দখলে যাচ্ছে, কিন্তু এর বেশি হচ্ছেনা। তাহলে, আমাদের উচিৎ হবে বাকি ১.৫ শতাংশ কোটা সুবিধা দেওয়া, যাতে করে তাদের সংখ্যা অন্তত ২ শতাংশ থাকে। অথবা, ধরে নিচ্ছি তারা নিজ যোগ্যতায় কেউই উঠে আসতে পারছেনা। তাহলে আমাদের যেটা করা উচিৎ, তা হল, তাদের জন্য পুরো ২ শতাংশ কোটাই বরাদ্দ করা। তাহলে ২ শতাংশের নিচে নামার আর কোনো ভয় নাই। কিন্তু বাস্তবে তারা ভোগ করছে ৫ শতাংশ কোটা! তাহলে কোটার মূল উদ্দেশ্য কি ঠিক থাকল? আমরা তাদের উপরে তুলতে গিয়ে বাকি ৯৮ শতাংশ মানুষদের কি বঞ্চিত করছি না? আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখা উচিৎ।
এখন আসা যাক জেলা কোটায়। বিসিএস এর ক্ষেত্রে প্রত্যেক বছর ১০ শতাংশ ক্যাডার জেলা কোটায় নেওয়া হয়। কিন্তু এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। এই ছোট একটি জায়গায় জেলায় জেলায় আলাদা করে কোটা রাখার কি আদোও কোনো প্রয়োজন আছে? জেলায় জেলায় কোটা দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটিকে জটিল না করে, জেলা কোটা বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকেই।
এরপর আসি নারী কোটায়। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯.৫৬ শতাংশই নারী। বর্তমানে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে ১৫ শতাংশ ও প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষিত রেখে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, নারীরা আমাদের সমাজে পিছিয়ে আছে কিনা? আর যদি পিছিয়ে থাকে, তাহলে কতটুকু পিছিয়ে আছে?
এর উত্তরে অনেক রকমের মত রয়েছে। কেউ বলছে, নারী কোটা এখনই তুলে দেওয়া উচিৎ হবে না। তবে অদূর ভবিষ্যতেই এর অবসান ঘটানো যেতে পারে। আবার অনেকেই বলছে, নারীরা আসলে পিছিয়ে নেই, ভবিষ্যতে বরং মেডিকেল কলেজগুলোতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু কিছু বিষয়ে ছেলেদের জন্য কোটা রাখার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে! কেউ কেউ আবার আক্ষেপ করে বলছে যে, মেয়েদেরকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে কেন ছেলেদের বেকারত্বের হার বাড়ানো হবে? এরকম অনেক ছোট-বড় প্রশ্ন নিয়ে নারী কোটার সমালোচনা করে যাচ্ছে অনেকেই। তাছাড়া, কোটা সংস্কার আন্দোলনগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত!
ইউনেস্কোর তথ্যমতে, ২০১৬ সালে আমাদের দেশে নারী শিক্ষার হার ছিল ৬৯.৯ শতাংশ। যেখানে, পুরুষদের শিক্ষার হার ছিল ৭৫.৬২ শতাংশ। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, একই সময়ে ১৫-২৪ বছর বয়সী ছেলেদের শিক্ষার হার ছিল ৯০.৯১ শতাংশ। যেখানে, ১৫-২৪ বছর বয়সী মেয়েদের শিক্ষার হার ছিল ৯৩.৫৪ শতাংশ! এখানে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট যে, মেয়েরা আসলে ছেলেদের চেয়েও এগিয়ে যাচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে নারীরাও; ছবি: আনোয়ার হোসাইন |
এরপর আসা যাক মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। প্রথম শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে সবচেয়ে বেশি যে কোটা, সেটি মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনীরা শতকরা ৩০ শতাংশ কোটা সুবিধা ভোগ করে থাকে।
আমরা জানি, কোটা একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য। কোনো প্রকার পুরস্কার হিসেবে কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। এখন দেখতে হবে, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো কি সাধারণ জনগণের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে? তাঁরা যদি পিছিয়ে নাও থাকে তবে কি শুধুমাত্র পুরস্কার হিসেবে তাঁদের কোটা পাওয়া উচিৎ? পুরস্কার হিসেবেও যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা যেতে পারে, তাহলে নাতি-নাতনীদেরও কোটা সুবিধা পাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? আর অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ কোটাই বা কতটুকু মানানসই?
এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্য দূর করে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সেই সময় ৭ কোটি মানুষের মধ্যে সবাই যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ। এরাও আবার ২ ধরনের। প্রথম প্রকার, যারা ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে জাতির স্বার্থে প্রাণ নিয়েছে; আর দ্বিতীয় প্রকার যারা জাতির স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজ স্বার্থে মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। এদের একদলকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলি, আর অপর দলকে যুদ্ধাপরাধী।
পার্থক্যটা কোথায়? উত্তর হচ্ছে, নীতিগত দিক থেকে এবং আচরণগত দিক থেকে। আর এই পার্থক্যের কারণেই একদল আমাদের কাছে অনেক সম্মানের আর আরেকদল আমাদের কাছে ঘৃণিত। যেই ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগের কারনে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের কাছে অনেক সম্মানের, আজ সেই সম্মানের জায়গা থেকে নেমে এসে তো তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে আলোচনা করার কথা না।
এখন প্রশ্ন হল, আমাদের জন্য যাদের এই ত্যাগ স্বীকার এবং যারা কখনোও নিজেদের স্বার্থের জন্য আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবেনা, তাদের জন্য কি আমাদের কোনো করণীয় নেই?
আছে, অবশ্যই আছে। তবে তা কোটা দিয়ে নয়। ধরে নিলাম, দুইজন মুক্তিযোদ্ধার একজন যুদ্ধে গিয়ে নিজের একটি পা হারিয়েছে। ফলে তাঁর আর বিয়ে হয়নি। সুতরাং, তাঁর কোনো সন্তানও নেই। আর অন্যজন একজন ধনী ব্যবসায়ী। তাঁর আছে ৫ টি ছেলে। এখন আমরা যদি এখানে কোটা ব্যবস্থা প্রয়োগ করি, তাহলে ব্যাপারটা কতটা উদ্ভট তা পরিস্কার হয়ে যাবে। আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনীরা যদি তাদের দাদা-দাদীর অবদানের অজুহাতে বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে, তাহলে রাজাকারদের নাতি-নাতনীদেরকে কেন বিসিএস থেকে নিষিদ্ধ করা হবে না! আসলে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি দেখতে দেখতে আমরা ভুলেই গেছি যে, স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকটি শিশুই সমান অধিকার নিয়ে জন্মায়।
গলায় সনদ ঝুলিয়ে ও রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে শিক্ষার্থীরা; ছবি: Md Eadrish Ali |
কোটা শুধুমাত্র অনগ্রসর ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার। বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন্যই একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছেন। সুতরাং, পুরস্কার হিসেবে কোটার প্রচলনটা অযোক্তিক এবং সংবিধান বিরোধীও বটে।
এখন অনেকেই বলবে যে, অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারই তো অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আওতায় পরে, তারাও কি কোটা পাবেনা! হ্যাঁ, আমি আপনাদের সাথে একমত। যারা সত্যিকার অর্থেই অভাব-অনটনে আছে তাদের জন্য অবশ্যই কোটার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। কিন্তু আর্থিক ভাবে সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য কোটা সুবিধা রাখাটা তেলের মাথায় তেল দেওয়ার মতই হাস্যকর!
এখন আসি সংখ্যায়। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.১৩ শতাংশ। এদের মধ্যে যে সবাই অস্বচ্ছল নয় এটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা না। কিন্তু তাদের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ কোটা!
এখন অনেকেই বলবে যে, অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারই তো অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আওতায় পরে, তারাও কি কোটা পাবেনা! হ্যাঁ, আমি আপনাদের সাথে একমত। যারা সত্যিকার অর্থেই অভাব-অনটনে আছে তাদের জন্য অবশ্যই কোটার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। কিন্তু আর্থিক ভাবে সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য কোটা সুবিধা রাখাটা তেলের মাথায় তেল দেওয়ার মতই হাস্যকর!
এখন আসি সংখ্যায়। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.১৩ শতাংশ। এদের মধ্যে যে সবাই অস্বচ্ছল নয় এটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা না। কিন্তু তাদের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ কোটা!
পাশের বাড়ির দারোয়ান মতিন মিয়া তো মজা করে বলেই ফেলল, “মামা যদি একটা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিতে পারতাম, তাইলে দেখতেন আইজ পুরা দেশটা দখল কইরা ফালাইতাম।"
আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিভাবে?”
উনি উত্তর দিলেন, “এইডাতো একেবারে সোজা। আমার তো এমনেই তিনটা বউ, তখন আরও দুই একটা বিয়ে করতাম। তারপর অনেকগুলা বাচ্চা। তারপর অগুলারেও অনেকগুলা বিয়া করাইতাম। অগুলারও অনেকগুলা বাচ্চা হইত। তারপর সবগুলারে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়াইতাম।"
আমি তো শুনে হাসতে হাসতে শেষ! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, সে তো কিছু ভুল বলে নাই। ৩০% কোটা কোনোবারই তো পূরণ হয়না। আর ছেলে ক্যাডার হয়ে গেলেই তো আর নাতির কোটা বাতিল হয়ে যাচ্ছে না!
এর পরও হয়ত অনেকে বলতে পারে যে, শুধু অস্বচ্ছল পরিবারকে দিলেই হবে না, মুক্তিযোদ্ধা কোটাটা অনেকটা পুরস্কার হিসেবেই থাকতে হবে। তাদেরকে আমি বলতে চাই, তাহলে আপনারা সবার আগে জাতীয় সংসদে ৩০% কোটার দাবি জানান। দেশ যাদের হাত ধরে স্বাধীন হল, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনীরাই তো দেশ চালানোর দায়ভার হাতে নিবে! আশা করা যায় রাজনীতিবীদরা খুব সহজেই আপনাদের এ দাবী মেনে নিবে।
এরপর আপনারা চাইলে, জাতীয় ক্রিকেট দলেও কোটা চাইতে পারেন। দেশের হয়ে লড়ার জন্য আক্ষরিক অর্থেই মাঠে নামার সুযোগ রয়েছে এখানে! হয়ত কোটার কারণে দল একটু দুর্বল হতে পারে। কিন্তু তাতে আর কি আসে যায়! এ তো আর দেশের আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতা সৃষ্টির সম্ভাবনার চেয়ে বেশি গুরুত্বর নয়! এখন অনেকেই বলবে, বিসিএস এ পাস মার্ক পাওয়া ছাড়া কোটা ধারীকেও নেওয়া হয়না। সুতরাং তারা অবশ্যই যোগ্য। তাদেরকে বলব, তাহলে নিয়মটা এমন করা উচিৎ যে, জাতীয় দলে প্রথম একাদশে কোটাধারীদের প্রবেশ করতে হলে কমপক্ষে এ-দলে জায়গা করে নিতে হবে। এখন মনে হয় আপনাদের জাতীয় দলে কোটা নিয়ে আর কেউ দ্বিমত করবেনা।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, বিসিএস পরীক্ষায় কি সবসময় যোগ্য ব্যক্তিটিই ভালো পজিশন পায়? যদি না পায়, তবে শুধুমাত্র পাস মার্ক পাওয়া কোটাধারীকে কেন কম যোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে?
আসলে পরীক্ষা পদ্ধতিতে যদি দুর্বলতা থাকে, তাহলে আমাদের অবশ্যই পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করতে হবে। কিন্তু তাই বলে দুর্বল পরীক্ষা পদ্ধতির দোহাই দিয়ে কোটাধারীর যোগ্যতা বাড়িয়ে দেওয়াটা হাস্যকর!
বর্তমান সময়ে আরেকটি প্রসঙ্গ খুব আলোচনায় আসছে, তা হচ্ছে 'ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা'। আমরা জানি, প্রত্যেকবার নতুন সরকার আসে আর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ডও পাল্টেছে ১০ বার। একই সাথে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও। আর এসব কারণে অনেকেই মনে করছে, একদিকে যেমন বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা, তেমনি অপরদিকে কমছে তাঁদের সম্মান।
অনেকেই বলে, কোটা ব্যবস্থা তো অনেক দেশেই আছে। আমাদের দেশের মানুষদের এটা মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? যারা এই ধরনের কথা বলে তাদেরকে বলব পুরোটা জেনে তারপর কথা বলতে। যুক্তরাষ্ট্রে কোটাধারীদের আগে থেকেই একটা নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওপেন পরীক্ষায় তাদের বাকি সবার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। আর ভারতে কোটা দেওয়া হয় উপার্জনের ভিত্তিতে। অর্থাৎ, উচ্চ আয়ের মানুষরা কোটা পায় না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোও এক্ষেত্রে ছাড় পায় না। আর একবার যে কোটার সুবিধা পাবে, সে আর কখনও কোটার সুবিধা পাবে না। অর্থাৎ বাবা যদি কোটা সুবিধা পায় তার সন্তানরা কোনো কোটা সুবিধা পাবে না। কেউ যদি কোটা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়, তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাবে না। আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটায় ভর্তি হয়েছে, সে কখনও চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবে না।
কিন্তু বাংলাদেশে একই পরিবার থেকে একাধিক ব্যক্তি কোটা সুবিধা ভোগ করা ছাড়াও অনেকেই বংশ পরম্পরায় বছরের পর বছর এই সুবিধা ভোগ করে আসছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা নিচ্ছে, তারা চাকরিতে ঢোকার ক্ষেত্রে আবারও নিতে পারছে। সুতরাং বাইরের দেশের কোটা ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে এখানে পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত তিনটি পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মস কমিশন স্থাপন করেছে। তিনটি কমিশনই সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে, কোটা একেবারে তুলে দেয়া উচিত। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। কোনো প্রকার সংস্কারের কথা তারা বলেনি। তারা বলেছে এটি সময় নিয়ে একেবারে বন্ধ করে দিতে। আর এসব কমিশন কিন্তু আমার আপনার মত আম জনতাদের নিয়ে করা হয়নি। প্রশাসনের সবথেকে যোগ্য লোকদের নিয়েই কমিশন গুলো করা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিষয়টি এতটা সুস্পষ্ট হওয়ার পরও কেন এর সংস্কার হতে এত সময় লাগছে?
আসলে কোটা ব্যবস্থার কারনে অনেক লোকই লাভবান হয়। আর তারা কোটা ব্যবস্থা অটুট রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর সাথে কিছু রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত আছে। আর এ কারণেই সারা দেশের মানুষের তীব্র অসন্তোষ থাকার পরও কোটা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বর্তমানে সারাদেশে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ’ এর ব্যানারে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছে:
১. কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
২. কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দিতে হবে।
৩. সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন কাটমার্ক ও বয়স-সীমা নির্ধারণ করতে হবে (মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে চাকরির বয়স-সীমা ৩২ বছর, কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য তা ৩০ বছর)
৪. কোটাধারীদের জন্য কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া যাবে না (কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেদনই করতে দেওয়া হয় না, কেবল কোটাধারীরা আবেদন করতে পারে)
৫. নিয়োগ পরীক্ষায় কোটার সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না।
কোটা সংস্কারের দাবিতে উত্তাল সারাদেশ |
তবে, শুধু কোটা সংস্কার করলেই হবে না। আমাদের দেশের বিসিএস নিয়োগ পদ্ধতিতেও কিছু পরিবরতন আনা দরকার। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, “বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পদ্ধতিতে অসঙ্গতি রয়েছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন চায়, সব পদের জন্য একই পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ হবে। এটি একটি উদ্ভট ধারণা। এর মাধ্যমে সঠিক ক্যাডার পাওয়া যায় না।” তিনি বলেন, “পজিশন বেইজড যোগ্যতম ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু পদে নেতৃত্বের গুণাবলীর ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত। বাকি সব পদে পজিশন ভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে এ রকম বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার।”
আমাদের দেশের কোটা পদ্ধতি অনেকটা উদ্ভট হওয়ার পরও কিছু মানুষকে বরাবরই দেখা যায় প্রকাশ্যে এর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে। তাদের প্রত্যকেরই কিছু না কিছু স্বার্থ জড়িত আছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে এর পক্ষে কথা বলে। আবার কেউ কেউ নিজের দুর্বলতাকে ঢাকার জন্য এবং অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করার লোভে এর পক্ষ নিয়ে কথা বলে।
তবে, আমাদের একটি কথা সবসময় মনে রাখা দরকার, কোটা পদ্ধতি কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। এটি একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। তাই, যুগ যুগ ধরে এটি চলতে পারে না।
সামাজিক দূরত্বের বাইক-স্কুটি তৈরি আরো জানতে https://www.gazipurkotha.com/সামাজিক-দূরত্বের-বাইক-স্কুটি-তৈরি/22179
ReplyDelete